করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে চীনা অর্থনীতি। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের এমন বিপর্যয়ের মধ্যেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন তৈরী পোশাক শিল্পের এদেশী উদ্যোক্তারা। তাদের আশা, করোনার প্রভাবে চীনের রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের ধস নামতে পারে। আর এ সুযোগে অর্ডার বাড়তে পারে বাংলাদেশের। এ জন্য এখনই দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণের দাবি করে রফতানিকারকরা বলছেন, সময়মতো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে অর্ডার চলে যাবে ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়াসহ আশপাশের দেশে। চীনের কারণে শূন্য হয়ে ওঠা বিশ্ববাজার ধরতে ডলারের বিপরীতে টাকার ক্রমাবনতির পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুৎ ও বন্দর সুবিধা বাড়ানোর দাবি জানান পোশাক শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যমতে, বর্তমানে তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজার ৪২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এ মার্কেটের বেশির ভাগ দখল করে আছে চীন। ২০১৭ সালে মোট বাজারের প্রায় ৩৫ শতাংশ দখল করেছিল চীন। ২০১৮ সালে এসে তা সাড়ে ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের অবস্থান কখনও দ্বিতীয়, কখনও তৃতীয়। তবে সাম্প্রতিক ভিয়েতনামের দ্রুত উত্থানে তীব্র চাপের মুখে পড়েছেন এ দেশের রফতানিকারকরা।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০১৯ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত, তুরস্ক, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এই শীর্ষ ১০টি অঞ্চল ও দেশ ৪২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরী পোশাক রফতানি করেছে, যা বিশ্বের মোট রফতানির ৮৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে চীন। বৈশ্বিক বাজারে দৈশটির হিস্যা ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ। পোশাক রফতানিতে চীনের পেছনেই আছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ তিন হাজার ২৯২ কোটি এবং ভিয়েতনাম তিন হাজার ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। উভয় দেশের বাজার হিস্যা এখন প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে। গত বছর ১০ শীর্ষ রফতানিকারকের মধ্যে বাংলাদেশের বাজার হিস্যা ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্য দিকে ভিয়েতনামের বাজার হিস্যা বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
এরই মধ্যে চীনে মহামারী আকার ধারণ করেছে করোনা ভাইরাস। আর এ ভাইরাসে প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। নতুন করে ৪২ জনের মৃত্যু হওয়ায় এ পর্যন্ত দেশটির মূল ভূখণ্ডেই মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৩ জনে। আর আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার ৬৯২ জন। বিশ্লেষকদের ধারণা, করোনা ভাইরাসের কারণে তীব্র চাপে পড়বে চীনের অর্থনীতিও। এরই মধ্যে চীন সফর বাতিল করেছেন শত শত আমদানিকারক। চীনের বেসামরিক উড়োজাহাজ কর্তৃপক্ষ বাতিল টিকিটের টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়ার পর দেশটির তিনটি প্রধান এয়ারলাইন : চায়না সাদার্ন এয়ারলাইন্স, চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স এবং চায়না এয়ারের শেয়ার দর পড়ে গেছে। চলতি সপ্তাহে চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের শেয়ারদর ১৩ শতাংশ কমে গেছে। চীনের বৃহত্তম অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি ট্রিপ ডট কম এরই মধ্যে হোটেল বুক, গাড়ি ভাড়া এবং পর্যটন এলাকার টিকিট বুকিং বাতিলে ফি মওকুফ ঘোষণা করেছে।
করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ১৩টি শহরের সাথে বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে সরকার। ফলে প্রচুর মানুষ উড়োজাহাজের টিকিট ও হোটেল বুকিং বাতিল করছে। এ দিকে হোটেল কোম্পানিগুলোও উহানসহ চীনের বিভিন্ন শহরে ভ্রমণেচ্ছুদের হোটেল বুকিং বাতিল করলে টাকা ফেরত দিচ্ছে। ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলস গ্রুপ এবং হায়াত নতুন চান্দ্রবছর বরণ মৌসুমে চীনের কেউ হোটেল বুকিং বাতিল বা তারিখ পরিবর্তন করতে চাইলে তা বিনাখরচে করে দিচ্ছে। চীনে ইন্টার কন্টিনেন্টালের ৪৪৩টি হোটেল রয়েছে। অধিকাংশ এয়ারলাইন্স ভাড়ার টাকা ফেরত দেয়া ও প্রয়োজনে কোনো ফি ছাড়াই আবার বুক করার সুযোগ দিচ্ছে। বড় হোটেলগুলোতে প্রচুর সিট খালি থাকছে।
করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা অনুমান করার ক্ষেত্রে ২০০২-০৩ সালের দিকে চীনে দেখা দেয়া করোনা ভাইরাসের সমগোত্রীয় সার্সের (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম) প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে সবচেয়ে উপযুক্ত উদাহরণ সার্স প্রাদুর্ভাবের ঘটনা। ওই ভাইরাসটিরও উৎপত্তি হয়েছিল চীনে। সেসময় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বিশ্ব অর্থনীতি। বিশ্ব অর্থনীতিতে এর ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার। লন্ডন-ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের জেনিফার ম্যাককেওন জানান, ২০০৩ সালে সার্সের কারণে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল পুরো এক শতাংশ। এবার নতুন ভাইরাসের কারণেও চীনা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর পরবর্তী ১৮ মাসের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাড়ে ছয় কোটি মানুষ উজাড় হয়ে যাবে বলে কয়েক মাস আগে সতর্ক করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গত বছরের অক্টোবর মাসে এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিখ্যাত গবেষণাকেন্দ্র জন হপকিনস সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটি নতুন একটি ভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছিলেন, এতে আক্রান্ত হয়ে ছয় কোটি মানুষ মারা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের সতর্কতার মাত্র তিন মাস পরই গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের তিন হাজার বয়সী শহর উহানে প্রথম করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে।
চীনের ওপর দিয়ে বয়ে চলা এ বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে তৈরী পোশাক রফতানি বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে মন্তব্য করে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধারা অনুযায়ী, চীন থেকে রফতানি কমলে অপরাপর রফতানিকারক দেশ থেকে বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে বর্তমানে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের সম্ভাবনাই বেশি। বায়াররা ইতোমধ্যেই যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, দেখা গেছে একই কোম্পানি চীন থেকেও পোশাক কেনে, বাংলাদেশ থেকেও কেনে। পরিস্থিতি বিবেচনায় চীনে অর্ডার কমিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে বাড়িয়ে দেয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা কতটা প্রস্তুত? আমাদের পোশাক শিল্প নানা সমস্যায় জর্জরিত। আমাদের বন্দর নিয়ে নানা সমস্যা। ডলারের বিপরীতে টাকা মান কমানোর দাবিটি দীর্ঘ দিনেও আমলে নেয়নি সরকার। কাজেই নতুনভাবে তৈরি হওয়া সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে আমাদের উচিত খুব দ্রুত নিজেদেরকে প্রস্তুত করা।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিশ্ববাজারে এক হাজার ৯৩০ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল দুই হাজার ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ ৭০ হাজার ডলারের পণ্য। অর্থাৎ গত অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে রফতানি কমেছে ১১৯ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার ডলার বা ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রফতানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির যে ধারা শুরু হয়, প্রথমার্ধ শেষেও তা অব্যাহত আছে। এ জন্য তৈরী পোশাক শিল্প খাতের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পোশাক রফতানি হয় এক হাজার ৬০২ কোটি ৪০ লাখ ১০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল এক হাজার ৭০৮ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার ডলারের পোশাক। এ হিসেবে ছয় মাসে পোশাক রফতানি কমেছে ১০৬ কোটি ডলারের বেশি তথা ৬ দশমিক ২১ শতাংশ।
Leave a Reply