উপজেলা পরিষদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব মাঠ প্রশাসনের। এই দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছানোয় তা উচ্চ আদালতে গড়িয়েছে। রিট করেছে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। গতকাল সোমবার তারা এ রিট করেন। রিট আবেদনে উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এই ধারায় ইউএনওদের উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও আর্থিক শৃঙ্খলা আনয়নসহ সাচিবিক দায়িত্ব পালনের বিধান রাখা আছে। এ ছাড়া ইউএনওরা বিভিন্ন আমন্ত্রণপত্রে উপজেলা পরিষদ না লিখে উপজেলা প্রশাসন লিখে থাকেন- এরও বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি আদেশ বাস্তবায়নে যেসব কমিটি গঠন করা হয়, সেসব কমিটিতে ইউএনওকে চেয়ারম্যান করার বৈধতাও চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। রিটে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইন সচিবসহ ১৬ জনকে বিবাদী করা হয়েছে।
রিটে বাদী হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দুমকি উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ ও অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু, উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রিনা পারভীন, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিম আহম্মেদ ও ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার।
রিটে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে উত্থাপন করা হয়। আইনজীবী হিসেবে রয়েছেন ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজিম। পরে হাসান এমএস আজিম আমাদের সময়কে বলেন, উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা চ্যালেঞ্জ করেছি।
আইনের ৩৩ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হইবেন এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করিবেন।’ ৩৩-এর (২) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালন এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য কার্যাবলি পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পাদন করিবেন।’ আইনজীবী বলেন, পরিষদ কোনো সিদ্ধান্ত দিলে তা ইউএনও বাস্তবায়ন না করলে পরিষদের করণীয় কিছু থাকে না। কারণ ইউএনওর উপজেলা পরিষদের কাছে জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা আইনে রাখা হয়নি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্বাধীনতাকে এই একটি ধারার মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই ৩৩ ধারা সংবিধানের ৭ ও ৫৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ৫৯ (১)-এ স্থানীয় শাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’
ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজিম আরও বলেন, মাঠ প্রশাসন কোনো চিঠিপত্র লিখলে বা অনুষ্ঠান করলে দাওয়াতপত্র বা ব্যানারে উপজেলা পরিষদ না লিখে লিখছে উপজেলা প্রশাসন। এই ‘উপজেলা প্রশাসন’ কোথাও উল্লেখ নেই। এর মাধ্যমে ইউএনওরা স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন। এ ছাড়া সরকারি কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে যত কমিটি গঠন করা হয় তার সবগুলোয় ইউএনওকে চেয়ারম্যান করা হয় এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের করা হয় উপদেষ্টা। আবার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় উল্লেখ থাকে ইউএনও ইচ্ছে করলেই আরও সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। এর মধ্য দিয়ে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। এমনি অনেক ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের হিসাবও তাদের দেওয়া হয় না। যা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও স্থানীয় সরকার পদ্ধতির চেতনার পরিপন্থী। রিট আবেদনে অন্তর্বর্তী নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে।
উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ হাওলাদার বলেন, উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ (সংশোধিত ২০১১) অনুযায়ী উপজেলায় থাকা ১৭টি দপ্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের কাজ উপজেলায় হস্তান্তরিত। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওই ১৭টি বিভাগের যেসব কমিটি করা হয়েছে এর সবগুলোতেই সভাপতি নির্বাহী কর্মকর্তা। আর উপদেষ্টা করা হয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যানকে। একইভাবে আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা হচ্ছেন ইউএনও এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা। অথচ একই প্রজ্ঞাপনে ইউনিয়ন ও পৌরসভায় আয়ন-ব্যয়ন কমিটির সভাপতি হচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র।
অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন, দেশের ৪৯২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন ১ হাজার ৪৭৬ জন। গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিরা সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের কোনো দায়িত্বই যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, উল্টো সব ক্ষমতা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং চেয়ারম্যান তথা পরিষদের দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম আমিনুজ্জামান বলেন, উপজেলার দুটি চেহারা। একটি হচ্ছে স্থানীয় সরকার, অন্যটি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব। তবে স্থানীয় সরকারের আদেশ-নির্দেশ প্রতিপালন করা হচ্ছে পরিষদের মূল কাজ। তিনি বলেন, সরকার ইউএনওর কো-অর্ডিনেটিং ক্ষমতাকে আরেকটু বাড়িয়ে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করেছে। এর অর্থ হচ্ছে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তথা পরিষদের প্রধান নির্বাহী নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবেন। নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি পরিষদের অন্যান্য সরকারি দপ্তরের কাজ মনিটরিং করবেন। কিন্তু তা হচ্ছে না। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি (ইউএনও) কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনাও বাস্তবায়ন করবেন।
ড. আমিনুজ্জামান বলেন, ইউএনও উপজেলা চেয়ারম্যানের ডান হাত হিসেবে কাজ করার কথা। তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা করছেন না। অর্থাৎ চেয়ারম্যান যেসব আদেশ-নির্দেশ দেবেন, সেগুলো প্রতিপালন করাই হচ্ছে সাচিবিক দায়িত্ব। যখন কোনো সিদ্ধান্ত হয় সেগুলো বাস্তবায়নে মনিটরিং করবেন। এটা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার কাজ। তিনি বলেন, আইনে সব কিছু যথাযথভাবে বলা হলেও বাস্তবে কার্যকর না হওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে।
Leave a Reply