জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণ কেন্দ্র করে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের হঠাৎ বিরোধিতায় দেশে উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে নানামুখী তর্কবিতর্কের মধ্যেই গত শুক্রবার রাতে কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর আরেকটি ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সরকার ও ক্ষমতাসীন দল এতদিন নমনীয় ভাব দেখালেও কুষ্টিয়ার ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গতকাল রবিবার দিনভর জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। আইনজীবীরাও বিক্ষোভ করেছেন। বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন।
কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের দুজন মাদ্রাসাশিক্ষক ও দুজন মাদ্রাসাছাত্র। পুলিশ বলছে, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের বয়ানে উদ্বুদ্ধ হয়ে দুই মাদ্রাসাছাত্র বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভাস্কর্য নিয়ে বিরোধ ও বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। এর পেছনে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যদি কেউ মনে করেন, তারা অনেক শক্তিশালী হয়ে গেছেন, এটি তাদের ধারণার ভুল। বিএনপি প্রকাশ্যে কিছু না বললেও ভাস্কর্য ইস্যুটিকে ‘স্পর্শকাতর ও রাজনৈতিক’ হিসেবে মনে করছে। গত শনিবার দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে সব মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। ভাস্কর্য ইস্যুটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে পর্যবেক্ষণেরও সিদ্ধান্ত হয়।
রাজধানীসহ দেশের নানা স্থানে ও প্রতিষ্ঠানে বহু বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য ভাস্কর্য থাকলেও সম্প্রতি ঢাকার যাত্রাবাড়ীর দোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর একটি সুউচ্চ ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতায় নামেন হেফাজত নেতারা। এই ভাস্কর্যটি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অংশ। এটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে তারা সরে আসতে বললেও এই আহ্বানে সাড়া দেওয়া হবে না বলে সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দাবিটি মানলে উগ্রপন্থিদের
প্রশ্রয় দেওয়া হবে মনে করছেন অনেকে।
হেফাজতে ইসলাম ও চরমোনাইসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো গত শুক্রবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল করে। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এর দুদিন আগেই ঢাকা শহরে কোনো ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক সভা-সমাবেশ করতে গেলে পুলিশের অনুমতির দরকার হবে বলে জানানো হয়। এর আগে চট্টগ্রামে ভাস্কর্যবিরোধী সমাবেশে বাধার মুখে যেতে পারেননি হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক।
দেশে আগেও বিভিন্ন সময় দাবির মুখে ভাস্কর্য অপসারণের ঘটনা ঘটে। সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে পরিচিত গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের পর স্থানান্তর করা হয়। সরিয়ে ফেলা হয় ঢাকায় বিমানবন্দর এবং জিপিওর সামনের ভাস্কর্যও। গত মাসের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি ঘিরে হঠাৎ করে আবারও ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।
আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ
কুষ্টিয়ায় ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীসহ সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। এসব কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি। তিনি বাংলাদেশের অস্তিত্ব। সেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে হাত দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী অপশক্তি বাংলাদেশের অস্তিত্বে আঘাত করেছে। তাই আর কোনো অপেক্ষায় নয়, মৌলবাদীদের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে। যেখানেই মৌলবাদী-জঙ্গিবাদীদের অপচেষ্টা হবে, সেখানেই প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
গতকাল বিকালে রাজধানীর গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, যুব মহিলা লীগ। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ৬৫টি ওয়ার্ডে বিক্ষোভ মিছিল হয়। সকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে ছাত্রলীগ। সমাবেশ থেকে কোনো ওয়াজ মাহফিলে রাজনৈতিক আলোচনা হলে তা প্রতিহতের ঘোষণা দেন ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। ভাস্কর্য ভাঙচুরে মদদদাতাসহ জড়িতদের যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই পেটানোর হুমকি দেন তিনি। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল বিক্ষোভ করে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো।
জনমত গড়ার সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে ভাস্কর্যকে ইস্যু করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা চলছে।
বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। গতকাল সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক লুৎফর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রায় ৫১ বছর আগে এই ৫ ডিসেম্বরেই বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ঐতিহাসিক এদিনটিতেই কিছু অকৃতজ্ঞ ও বেইমান তার নির্মাণাধীন ভাস্কর্যে আঘাত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
নিন্দা জানিয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ও। গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি (এপিইউবি)। গতকাল বিবৃতিতে সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ (বিএসপি)। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ড. কাজী এরতেজা হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন জিটু এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানান।
সুপ্রিমকোর্টে আইনজীবীদের বিক্ষোভ
ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন সুপ্রিমকোর্টের আওয়ামী সমর্থক আইনজীবীরা। গতকাল দুপুুরে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনের চত্বরে এ কর্মসূচি পালন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, নগর ছাত্রলীগ-যুবলীগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও চবি ছাত্রলীগ বিক্ষোভ করেছে। গত শনিবার রাতে নগরের জিইসি মোড় ও হালিশহর এলাকায় নগর ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং গতকাল সকালে চবির বঙ্গবন্ধু চত্বরে চবি প্রশাসন ও ছাত্রলীগ বিক্ষোভ মিছিল করে।
বরিশাল প্রতিনিধি জানান, বরিশাল নগরীর ১৪টি পয়েন্টে থাকা জাতির পিতার সব ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ঘিরে শনিবার রাতে পুলিশি প্রহরা বসানো হয়েছে। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার জাহাঙ্গীর মল্লিক জানান, ভাস্কর্য ইস্যুতে যেন নিরাপত্তার কোনো বিঘœ না ঘটে ও যে কোনো নাশকতামূলক কর্মকা- প্রতিহতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
Leave a Reply