সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি। মায়িশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটি ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে নিয়েছে ১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা ঋণ। ঢাকার সংসদ সদস্য আসলামুল হকের এ কোম্পানি একক ঋণগ্রহীতা সীমা লঙ্ঘন করে বাগিয়ে নিয়েছেন করোনাকালে ঘোষিত প্রণোদনা। এ রকম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যারা প্রভাব খাটিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, সময়মতো পরিশোধ না করে খেলাপি হয়েছেন, পেয়েছেন নিত্যনতুন সুবিধা। তারাই আবার পাচ্ছেন প্রণোদনার অর্থ। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মায়েশা গ্রুপের মতো বেক্সিমকো, এস আলম, থার্মেক্স ও নাভানা গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার অর্থ নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে দেওয়া বিশেষ প্রণোদনা অভিযুক্তদের পকেটে এভাবে তুলে দেওয়া উচিত হয়নি। এতে প্রণোদনার অর্থও শেষ পর্যন্ত ফেরত না আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানায়, করোনাকালের ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার মধ্যে বড় শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এ প্যাকেজের আওতায় ৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারছেন বড় শিল্পপতিরা।
ব্যাংক খাত থেকে ইতোমধ্যে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি গ্রুপ। শুধু সরকারি চার ব্যাংক থেকে মাত্র ৬৯ গ্রাহক নিয়েছেন ৫৯ হাজার কোটি টাকা। তারা কখনই ব্যাংকের টাকা ফেরত দেননি। খেলাপি হয়ে নিয়েছেন পুনর্গঠন, বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিল, গণছাড়, সুদ মওকুফসহ নানা সুবিধা। করোনার ক্ষতি কাটাতে ঘোষিত প্রণোদনার অর্থও তারাই নিচ্ছেন সবচেয়ে বেশি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রভাবশালী গ্রাহকরা আগেই বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন। সেই অর্থ ফেরত দেয়নি। এখন আবার তারাই প্রণোদনা পাচ্ছে। এতে আগের মতোই অর্থ ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একে ভর্তুকি হিসেবে ধরে নিতে হবে। যারা আগেই বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তাদেরই বেশি হারে প্রণোদনা দেওয়ায় কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে ছোট উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা বেশি দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো সে পথে হাঁটেনি। বড়রা বেশি পাওয়ায় রপ্তানিমুখী শিল্প সচল হতে সহজ হবে; কিন্তু রপ্তানি বাড়বে কিনা তা নির্ভর করছে ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা সংক্রমণের ওপর। কারণ সেখানে সংক্রমণ বাড়ছে। বড়দের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের শঙ্কা থাকলেও শিল্পকারখানা চালু হলে কর্মসংস্থানে সহায়ক হবে।
বিভিন্ন ব্যাংকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই গ্রাহকরা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা পকেটে ভরছেন। ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে আসলামুল হকের মায়িশা গ্রুপ ঋণ নিয়েছে ২ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। সিএলসি পাওয়ার কোম্পানির নামে নিয়েছে ১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত ছিল একক ঋণগ্রহীতার সীমার বেশি কোনো অর্থ প্রণোদনা দেওয়া যাবে না। সিএলসি কোম্পানির ক্ষেত্রে সুদসহ হিসাব করলে ন্যাশনাল ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি অতিক্রম করে। ন্যাশনাল ব্যাংকের একক ঋণগ্রহীতা সীমা ১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। কিন্তু আসলামুল হকের কোম্পানিকে প্রণোদনা দিতে সুদ বাদ দিয়ে তার ঋণ হিসাব করা হয়েছে। এরপর তাকে প্রণোদনা অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেও একটি গ্রুপকে প্রণোদনা পাইয়ে দিতে সহায়তা করেছে।
দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ ঋণগ্রহীতা বেক্সিমকো গ্রুপ। এ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালে বিপুল পরিমাণ বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিল করে। গ্রুপটির আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ‘সিঙ্গল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিটে’র বেশি প্রণোদনা দাবি করে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত দাবি অনুমোদন না করে সীমার মধ্যেই অনুমোদন করেছে। জনতা ব্যাংক থেকে বেক্সিম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শাইনপুকুর গার্মেন্টস ৪৫ কোটি, বেক্সটেক্স ৪৫ কোটি, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ৪৫ কোটি, ইন্টারন্যাশনার নিটওয়ার অ্যান্ড অ্যাপারেলস ১ ও ২টি কোম্পানির নামে ৮০ কোটি টাকা প্রণোদনা পাচ্ছে। সোনালী ব্যাংক থেকে গুলশান স্পিনিং মিলস সাড়ে ৭ কোটি ও গুলশান স্পিনিং মিলসের ১, ২ ও রোটর নামে ১৬ কোটি টাকা প্রণোদনা নিয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি প্রণোদনা নিয়েছে এবং প্রক্রিয়াধীন।
ব্যাংক খাতের আলোচিত গ্রুপ থার্মেক্স। বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে গ্রুপটির ঋণ ৫ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সময়ে খেলাপি হয়ে গেছে। খেলাপিদের দেওয়া সব ধরনের সুবিধা পেয়েছে গ্রুপটি। আবদুল কাদের মোল্যার মালিকানাধীন এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জনতাসহ কয়েকটি ব্যাংকের একক ঋণগ্রহীতা সীমাও লঙ্ঘন করেছে। জনতা ব্যাংক থেকে থার্মেক্স স্পিনিং ২০ কোটি, থার্মেক্স ওভেন ডাইং ১২ কোটি ও থার্মেক্স মিলাঞ্জ স্পিনিং মিলস নামে ১৫ কোটি প্রণোদনা পাচ্ছে। সোনালী ব্যাংক থেকে থার্মেক্স মিলাঞ্জ নামে ২১ কোটি, থার্মেক্স নিট ইয়ার্ন নামে ২০ কোটি, থার্মেক্স চেক ফেব্রিক্স নামে ১৫ কোটি ও ইনডিগো স্পিনিং নামে ২৮ কোটি টাকা নিয়েছে। অগ্রণী ব্যাংক থেকে থার্মেক্স কালার নামে ১৫ কোটি, থার্মেক্স মিলাঞ্জ ২০ কোটি, থার্মেক্স ক্লেজেড ইয়ার্ন নামে ১৫ কোটি ও আদুরী ফ্যাশন ৭ কোটি টাকা প্রণোদনা পেয়েছে।
নাভানা গ্রুপ ৩১টি ব্যাংক থেকে ৪ হাজার ৫০৩ কোটি এবং ২২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৭শ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দিয়ে খেলাপি হয়ে যায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ওই ঋণ টেকওভার করেছে সরকারি ব্যাংকগুলো। টেকওভার করায় তা এখন নিয়মিত ঋণ। জনতা ব্যাংক থেকে নাভানা এলপিজি ২০ কোটি এবং নাভানা ব্যাটারিজ ৫০ কোটি টাকা প্রণোদনা পাচ্ছে। রূপালী ব্যাংক থেকে ৯০ কোটি টাকা পেয়েছে নাভানা লিমিটেড।
এ ছাড়া ব্যাংক খাতের শীর্ষ ঋণগ্রহীতা এস আলম ও আবুল খায়েরের মতো বড় গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা পেয়েছে। জনতা ব্যাংক থেকে আবুল খায়ের লিমিটেড ২৫ কোটি, আবুল খায়ের স্টিল ১৫ কোটি, সোনালী ব্যাংক থেকে আবুল খায়ের লিমিটেড ১৮ কোটি, আবুল খায়ের স্টিল ৩০ কোটি টাকা প্রণোদনা নিয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঋণখেলাপিদের প্রণোদনার অর্থ না দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। যেসব গ্রাহকের ঋণ ফেরত দেওয়ার ইতিহাস খারাপ, ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি, নানা সুযোগসুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন- তাদের প্রণোদনার টাকা দেওয়া উচিত হবে না। এতে প্রণোদনার অর্থের অপচয় হবে। ব্যাংকিং খাতে নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়বে। অন্যদিকে যে উদ্দেশ্যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে সেটি সফল হবে না এবং প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই ঋণ-শৃঙ্খলা ও বিধিবদ্ধ নিয়মনীতি মেনেই প্রণোদনা দেওয়া উচিত।
একক গ্রাহককে অতিরিক্ত ঋণ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই না করেছে। একক ঋণগ্রহীতাকে অধিক ঋণ দেওয়ার কারণে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে একটি প্রতিবেদনে সেই বিষয়ে সতর্ক করা হয়। আর্থিক স্থিতিশীলতা শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, শীর্ষ ৩ ঋণগ্রহীতা ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ১২ ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়বে। আর শীর্ষ ৭ ঋণগ্রহীতা অর্থ ফেরত না দিলে সংকটে পড়বে ২০ ব্যাংক। কিন্তু এ ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিজেই বড় বড় ঋণগ্রহীতার প্রণোদনার অনুমোদন দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, বৃহৎ শিল্পপতিদের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ বাড়িয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়। ইতোমধ্যে ২৭ হাজার ১৮২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। সর্বমোট ২ হাজার ৩৫৮টি প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার অর্থ পেয়েছে। এর বাইরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিতরণ করছে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। মোট প্যাকেজের প্রায় ৮৫ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে। অথচ ছোট, ক্ষুদ্র, মাঝারি, কৃষকসহ অন্য নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ঘোষিত প্যাকেজের ঋণ বিতরণের অনেক পিছিয়ে ব্যাংকগুলো।
Leave a Reply