আগৈলঝাড়ায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত জাহান নোহার মৃত্যুরহস্য নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছেন জন্মদাতা বাবা ও মা। নোহার মৃত্যুর পাঁচ দিনের মাথায় বাবা ও মা ভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন স্থানীয় থানা এবং বরিশাল আদালতে। ফলে এ শিশুর মৃত্যুরহস্য ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। নয় বছরের শিশু নোহা সত্যিই আত্মহত্যা করেছে; নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে তা নিয়ে পরিবারের মাঝেই বিরোধ দেখা দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার স্কুলশিক্ষকের মারধরের কারণে নোহা অভিমানে আত্মহত্যা করেছে বলে দাবি করেন বাবা সুমন মিয়া। এ অভিযোগে নোহার স্কুলশিক্ষক শফিকুল ইসলামকে দায়ী করে তিনি আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা দায়ের করেন আগৈলঝাড়া থানায়। এদিকে গত সোমবার শিশুটির মা তানিয়া বেগম বাদী হয়ে বরিশাল আদালতে পাল্টা হত্যা মামলা দায়ের করেন। তানিয়া বেগম এজাহারে উল্লেখ করেন, তার মেয়েকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ জন্য শিশুটির বাবা, সৎমা ও ফুফুকে দায়ী করেছেন তিনি। আদালত নোহার ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর মামলাটির পরবর্তী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ইউনিয়নের খাজুরিয়া গ্রামের বিয়েপাগল (চারটি বিয়ে) হিসেবে পরিচিত সুমন মিয়ার মেয়ে নুসরাত জাহান নোহা ছিল তার তৃতীয় স্ত্রীর সন্তান। নোহার মা তানিয়া বেগমকে তালাক দেওয়ার পর চতুর্থ বিয়ে করেন তিনি। তবে আদালতের মাধ্যমে মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দেন তিনি। তার বর্তমান স্ত্রী ঝুমুর জামান আগের ঘরের সন্তান নোহাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না। নোহা স্থানীয় দারুল ফালাহ প্রি ক্যাডেট স্কুলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
আগৈলঝাড়া থানায় নোহার বাবা সুমন মিয়ার দায়েরকৃত আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার তার নিজের টিনশেড ঘরের দোতলায় আড়ার সঙ্গে ওড়না বেঁধে গলায় ফাঁস দেয় নোহা। ঝুলন্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্বজনরা। স্থানীয় পয়সারহাটের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সুমন মিয়ার অভিযোগ, তার মেয়ে যে স্কুলে পড়াশোনা করত, সেখানে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় নোহা অকৃতকার্য হয়। তাই তার মেয়েকে ওই স্কুলের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম নোহাকে মারধর ও বকা দেন। এতে বাড়িতে এসে পরিবারের অগোচরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সে। পর দিন বৃহস্পতিবার শিক্ষক শফিকুল ইসলামকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন সুমন।
মামলা দায়েরের পর নোহার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
এদিকে নোহার মা তানিয়া বেগম বরিশালের সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শাম্মি আক্তারের আদালতে মামলা দায়ের করেন। এতে তিনি দাবি করেন, তার মেয়ে আত্মহত্যা করেনি, তাকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মামলায় তিনি সাবেক স্বামী সুমন মিয়াকে প্রধান আসামি করেন। মামলায় আসামির সংখ্যা ৩। অপর দুই আসামি হলেন- সুমনের চতুর্থ স্ত্রী ঝুমুর জামান ও বোন লিপি বেগম।
তানিয়া বেগম এজাহারে আরও দাবি করেন, ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট সুমন মিয়া তাকে তালাক দেন। এর পর থেকে তিনি ঢাকায় বসবাস করেন। তার সন্তান নোহাকে সুমনের পিতা (নোহার দাদা) আবদুর রহিম মিয়া খুব আদর করতেন। কিন্তু তা সহ্য করতে পারতেন না সুমন ও তার স্ত্রী ঝুমুর।
গত ৯ সেপ্টেম্বর নোহা উপজেলার দারুল ফালাহ প্রি ক্যাডেট একাডেমিতে সাপ্তাহিক পরীক্ষা দিতে যায়। সেখানে কম নম্বর পাওয়ায় শিক্ষক তাকে বকাঝকা ও লাঠি দিয়ে পেটান বলে ওই পরিবারের সকলকে জানায়। এ জন্য ঘরে বসে সে কিছুক্ষণ কান্নাকাটিও করে।
বাদীর দাবি, এ ঘটনাকে পুঁজি করে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তার মেয়ে নোহাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন আসামিরা। এর পর গলায় গামছা পেঁচিয়ে নোহাকে আড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালানো হয়।
এজাহারে বলা হয়, ৯ বছরের একটি শিশু আত্মহত্যার কথা চিন্তাও করতে পারে না। সেখানে গামছা ও ওড়না যুক্ত করে আড়ার সঙ্গে ফাঁস দেওয়া কোনোভাবেই তার পক্ষে সম্ভব নয়।
নোহার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল ফালাহ প্রি-ক্যাডেট একাডেমির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন জানান, ঘটনার পর পরিচালনা কমিটির জরুরি সভা ডেকে মামলায় অভিযুক্ত শিক্ষক শফিকুল ইসলামকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তিনিও দাবি করেন, শিশু নোহা তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। নোহার নামে তার দাদা জমি লিখে দিতে চেয়েছিলেন। সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় পরিবারের সদস্যরা তাকে হত্যা করতে পারে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।
আগৈলঝাড়া থানার ওসি আফজাল হোসেন জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। নোহার মৃত্যুতে যারাই জড়িত থাকবে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, একটি ঘটনায় পক্ষে-বিপক্ষে দাবি অথবা পাল্টাপাল্টি মামলা হতেই পারে। পুলিশ শিশু নোহার মৃত্যুরহস্য সুষ্ঠু তদন্ত এবং ময়নাতদন্ত রিপোর্ট যাচাইবাছাই করে প্রকৃত ঘটনা আদালতে উপস্থাপন করবে। অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান পুলিশ সুপার।
Leave a Reply