করোনাকালে গত মার্চের শেষ থেকে সারাদেশে সিনেমা হল বন্ধ রয়েছে। এমন কঠিন সময়ে এ সিদ্ধান্ত খুবই যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু সিনেমা একটি শিল্প। করোনার কারণে দীর্ঘদিন সিনেমা হলগুলো বন্ধ রাখা উচিত হবে না। কারণ একটি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হাজার হাজার মানুষ কাজ করে থাকেন। চলচ্চিত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। করোনার মধ্যেও আমাদের জীবন বাঁচাতে হবে। তা হলে চলচ্চিত্রের মানুষদের কী বাঁচতে হবে না? অবশ্যই সেই অধিকার তাদের আছে। সিনেমা হল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে অনেকগুলো সমস্যার মুখে পড়তে যাচ্ছে চলচ্চিত্রশিল্প। প্রথমেই এটি শিল্প হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। আর কিছুদিন চলমান থাকলে অনেক সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে যাবে। এমনিতেই দেশের ৮০ শতাংশ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি যেগুলো আছে সেখানে সিনেমা চালানোর অবস্থায় নেই। কয়েকটি সিনেপ্লেক্স আমাদের আশা বাঁচিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে বন্ধ আরও দীর্ঘায়িত হলে সেই আশাতেও গুড়েবালি। ইতোমধ্যে স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। তারা বলেছে, এভাবে চললে এবং সরকার কোনো সহায়তা না দিলে সিনেপ্লেক্স একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। যেখানে সিনেপ্লেক্স বন্ধ হয়ে যেতে পারে, সেখানে সিনেমা হল তো আরও আগেই বন্ধ করে দেওয়ার অবস্থায় আছে। সিনেমা হল মালিকদের কথাই নয়, চলচ্চিত্রে যারা জড়িত তাদের কথা একটু ভাবুন। একটি সিনেমা বানাতে গেলে শত শত মানুষ সেই ছবির প্রডাকশনে কাজ করে থাকেন। আর তাদের রুটি-রুজিই হচ্ছে চলচ্চিত্র। হিসাব করে দেখলে আমাদের দেশে পাঁচ শতাধিক পরিচালক আছেন। হয়তো তাদের সবাই নিয়মিত সিনেমা নির্মাণ করেন না। কিন্তু তাদের জীবন চলার জন্য সিনেমাই প্রধান মাধ্যম। আবার চলচ্চিত্রে শিল্পী আছেন কয়েক হাজার। নামিদামি শিল্পীরা হয়তো জীবনে অনেক অর্থ উপার্জন করেছেন। কিন্তু যারা দিন কাজ করে খাওয়া শিল্পী, তাদের কী হবে? অনেকেই সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে চলছেন। এভাবে আর কতদিন। এসব শিল্পীর কথা ভেবে অবিলম্বে সিনেমা হল খুলে দিতে হবে। নতুন নতুন সিনেমা বানানোর জন্য সরকারের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সিনেমা হলগুলো না খুলতে পারলে এফডিসি দিয়েই কী হবে? এমনিতেই এফডিসির ফ্লোর ভেঙে কমপ্লেক্স করা শুরু হয়ে গেছে। হয়তো একদিন এফডিসিই থাকবে না। দেশে যদি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জায়গাই না থাকে, তা হলে নতুন ছবি বানিয়েই লাভ কী? এমনিতেই ছবির সংখ্যা দিনকে দিন কমছে। সিনেমা হলে চালানোর মতো ছবি পাওয়া যায় না। মালিকরা বিদেশি ছবি আমদানির জন্য জোর দাবি করে আসছেন। মাঝেমধ্যে আমদানিও হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে চলচ্চিত্রশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হলগুলো খুলে দেওয়া উচিত। আরও যে সমস্যায় পড়তে হবে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের, তা হলো যে পরিচালক ও শিল্পীদের নিয়ে সিনেমা বানিয়ে লাভের মুখ দেখেন প্রযোজকরা, সেই কলাকুশলীদের পাশে না দাঁড়িয়ে প্রযোজকরা আর কতদিন দামি গাড়িতে উঠতে পারবেন? এ প্রশ্নের উত্তর প্রযোজকদেরই খুঁজতে হবে। পরিচালক, শিল্পী, কলাকুশলী না বাঁচলে একদিন প্রযোজকরাও হারিয়ে যাবেন। চলচ্চিত্রে অভিনয় করে যারা বড় বড় তারকা হয়েছেন, তাদের যদি বড় পর্দায় মানুষ না দেখতে পারে তা হলে তারকাখ্যাতি আর কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন তারা। মানুষ যদি নতুন নতুন সিনেমা না দেখেন, তা হলে দেশে নতুন তারকা জন্ম নেবে কীভাবে? তারকারা হলেন মানুষের আইডল। অথচ নতুন সিনেমা হচ্ছে না। নতুন নতুন রাজ্জাক, আলমগীর, কবরী, ববিতার জন্ম হবে না, তা হলে চলচ্চিত্রশিল্প টিকবে কেমন করে? আমরা যারা সিনেমা হলে চলচ্চিত্র দেখে দেখে বড় হয়েছি, তাদের মনে অনেক দিন থেকেই দুঃখ। কারণ দেশে একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। আর সেই দৌড়ে এখন অনেকেই আছেন। যারা পরিকল্পনা করেছিলেন হল আর চালাবেন না, তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে করোনা। এই সুযোগে অনেক মালিকই সিনেমা হল আর খুলবেন না। করোনা অজুহাতে সিনেমা হল বন্ধ করে দেবেন। আবার অনেকেই বলছেন, সিনেমা হল খুললেই কী হবে? হলে চালাব কী? তাদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে, আগে খুলতে দিন। আর মুক্তি পাওয়ার লাইনে যেসব সিনেমা আছে সেগুলোকে প্রদর্শনের সুযোগ দিন। হল বুকিং রাজনীতি ছেড়ে চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করুন। গত দুই ঈদে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল যেসব ছবি, সেগুলো দিয়ে আপাতত সিনেমা হল সচল করুন। তার পর নতুন সিনেমা নিয়ে ভাবুন।
Leave a Reply