রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের নতুন সংযোগ ছয় বছর ধরে বন্ধ থাকলেও অবৈধভাবে ঠিকই মিলছে। সম্প্রতি বাড্ডা জোনে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় ১ হাজার ২৪৭ চুলা। সেগুলোকে আবার রাতের আঁধারেই কেন্দ্রীয় সার্ভারে যুক্ত করে দেওয়া হয় বৈধতা। কয়েক মাস ধরে অনলাইনে বিল জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর পরই সেগুলো ধরা পড়ে। এর পরই বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু বাড্ডা নয়, ঢাকা মেট্রো বিপণন ডিভিশন উত্তর ও দক্ষিণ, এমনকি আঞ্চলিক বিপণন ডিভিশন গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জেও কর্মকর্তাদের জোগসাজশে অবৈধ গ্যাস সংযোগের প্রবণতা বেড়েছে। এ কাজের সঙ্গে সিবিএ নেতা ও কম্পিউটার অপারেটরসংশ্লিষ্ট লোকজনও জড়িত। আর অবৈধকে বৈধতা দিতে দুর্নীতিবাজরা চাইলেই প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় সার্ভারে প্রবেশ করতে পারছে। বিষয়টি তদন্ত করে গঠিত কমিটি জানায়, এসব ঘটনায় প্রমাণ হয় যে, তিতাসের কেন্দ্রীয় সার্ভার সুরক্ষিত নয়।
বাড্ডা জোনে অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে তিতাসের পাঁচ কর্মকর্তা এবং চার নিরাপত্তাকর্মীর সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সে পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার অভিযুক্তদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত সেগুলোকেও কালো তালিকাভুক্তিসহ ঠিকাদারদের প্রতিনিধিকে তিতাস কার্যালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করেছে কমিটি। এ ছাড়াও তাদের কয়েক জনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অবৈধ এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যদের ধরতে সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আলী মো. আল মামুন আমাদের সময়কে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আরও অনেক অ্যাকশন বাকি আছে। এ ঘটনায় মামলাও করা হবে। অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, কাউকে একচুল ছাড় দেওয়া হবে না। অনিয়ম করে পার পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।’
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, কয়েক মাস আগে তিতাসের কয়েকটি জোন থেকে ১৭৩ বাড়িতে নতুন করে ১ হাজার ২৪৭টি চুলা তিতাসের সেন্ট্রাল সার্ভারে যুক্ত করা হয়। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই আবাসিক গ্যাস সংযোগ এবং নতুন করে চুলা বাড়ানো বন্ধ রয়েছে। বড় ধরনের এ দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়ার পরই নড়েচড়ে বসেন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতনরা। একই সঙ্গে তিতাসের সিস্টেম বাইরের কারও হাতে চলে গেল কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ হয়।
পরে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেন। উচ্চপদস্থ চার কর্মকর্তাকে নিয়ে গঠিত কমিটি দীর্ঘ সময় তদন্তে তিতাসের বেশ কিছু দুর্বলতা এবং কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ও অবহেলা খুঁজে পায়। আর মূল দুর্নীতির সঙ্গে সীমা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় কমিটি। অবৈধ এ কাজে জড়িত রয়েছে আরও সাতটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। তাই সব মিলিয়ে সেই আটটি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্তি এবং এদের প্রতিনিধিদের তিতাস কর্যালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির সুপারিশ করা হয়।
কমিটি তাদের সুপারিশে বলেছে, সীমা এন্টারপ্রাইজের মালিক অবৈধ গ্যাস সংযোগের মূলহোতা মো. রাকিব হোসেন ওরফে রাকিবকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে এ বিষয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। তার মাধ্যমেই অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং তিতাসের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়া সবাইকে খুঁজে পাওয়া যাবে। তাদের পুরো নেটওয়ার্ক সর্ম্পকে ধারাণা পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে তিতাসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ আউটসোর্সিং আইটি কোম্পানি ডিভাইন আইটি লিমিটেডের সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা, সে বিষয়টিও বেরিয়ে আসবে। এ বিষয়টি জানা অত্যন্ত জরুরি, কারণ কীভাবে তারা তিতাসের সার্ভারে ডাটা এন্ট্রি করেছে সেটা বের করা দরকার। এ বিষয়ে মো. রাকিবের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছে কমিটি।
এদিকে রহস্যজনক কারণে তিতাসের মেডাবিবি-৪ কার্যালয়ে দীর্ঘদিন কেন সিসি ক্যামেরা অচল হয়ে আছে। সেগুলো কেন এতদিনেও মেরামত করা হলো না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ করেছে কমিটি। এমনকি কমিটির তদন্তে কাজে ওই কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের অসহযোগিতারও অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী রতন চন্দ্র দে, ব্যবস্থাপক মো. রাকিত উদ্দিন সরদার, উপব্যবস্থাপক মো. রজব আলী, উপব্যস্থাপক মো. রেজাউল করিম খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন জাবেদ অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়ে খুবই খামখেয়ালিপনা বা দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন। অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়টি উদঘাটনেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন তারা। পরিকল্পিতভাবেই এ কর্মকর্তারা সিসি ক্যামেরা সচল করতে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেননি।
অন্য কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, এসব অবৈধ সংযোগের সঙ্গে উল্লেখিতদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি। পাশাপাশি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তের বিষয়েও বলা হয়েছে। এ ছাড়া গত ৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে যখন ১ হাজার ২৪৭টি চুলা এন্ট্রি হয় তখন নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্বে ছিলেন মো. মাসুদ রানা, মো. মাসুদুল হক, আবুল কালাম আজাদ। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত এবং কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠাতে সুপারিশ করা হয়েছে। নিরাপত্তা প্রহরী মো. ওয়াসিমের বিরুদ্ধেও শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি আউটসোর্সিং কোম্পানি প্যান্থারের সরবরাহকৃত এ নিরাপত্তা প্রহরীকে চাকরি থেকে অপসারণেরও সুপারিশ করেছে কমিটি।
এর বাইরেও আবাসিকে তিতাসে কয়েক লাখ অবৈধ সংযোগ রয়েছে। গত ছয় বছরে রাজধানী ও আশপাশের জেলা শহরে অনেক পুরনো ভবন বর্ধিত করা হয়েছে। সেসব ভবনে আগে থেকে বৈধ গ্যাস সংযোগ থাকার সুবাদে চুলা বাড়ানো হয়েছে, যেটি অবৈধ। অনেক আগেই এসব অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে তিতাস। পরে অবশ্য নানা প্রক্রিয়ায় সেগুলো বৈধ করে নেওয়া হয়। বছরখানেক আগে সাড়ে সাত লাখ অবৈধ সংযোগ নানা প্রক্রিয়ায় বৈধ করা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
এ ব্যাপারে তিতাসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘অবৈধ গ্যাস সংযোগের মাত্রা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে তিতাসের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িয়ে পড়ছেন। অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করে অনেককে শাস্তি দিলেও কমছে না দুর্নীতি-অনিয়ম।’ সম্প্রতি ১ হাজার ২৪৭টি চুলা তিতাসের কেন্দ্রীয় সার্ভারে যুক্ত করার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা, ‘বিষয়টি রীতিমতো তিতাসের জন্য উদ্বিগ্নের। এভাবে যদি বাইরে থেকে সার্ভারে অবৈধ সংযোগ যুক্ত করে দেওয়া যায়, তা হলে তিতাসের নিজস্ব ব্যবস্থা বলে আর কিছুই থাকল না।’
Leave a Reply