ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং হল সংসদ নির্বাচন নিয়ে উত্তাপ বাড়ছে টিএসসি ও হলপাড়ায়। ছয় বছর পর আবারও ভোটের মাঠে ফিরছে ডাকসু নির্বাচন। গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তনের প্রভাব এ নির্বাচনেও দৃশ্যমান।
তফসিল ঘোষণা: শুরু হলো আনুষ্ঠানিকতা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতিমধ্যে ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। ১৯ আগস্ট পর্যন্ত মনোনয়ন জমা দেওয়া যাবে, ২৫ আগস্ট প্রকাশিত হবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা এবং ভোট গ্রহণ হবে ৯ সেপ্টেম্বর।
বিশেষ দিক হলো—এবার কোনো বয়সসীমা থাকছে না। তবে প্রার্থী হতে হলে হতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী।
সান্ধ্যকালীন, এক্সিকিউটিভ মাস্টার্স, ডিপ্লোমা বা ভাষা কোর্সের শিক্ষার্থীরা প্রার্থী বা ভোটার হতে পারবেন না। একইভাবে সংযুক্ত কলেজ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরাও ভোটের বাইরে থাকছেন।
ভোট কেন্দ্র হবে হলের বাইরে
নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নয়, বরং ক্যাম্পাসের নির্ধারিত ছয়টি কেন্দ্রে হবে ভোটগ্রহণ। কেন্দ্রগুলো হল: কার্জন হল, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, সিনেট ভবন এবং উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
জোট গঠনে আগ্রহ, প্যানেলে পরিবর্তনের আভাস
তফসিল ঘোষণার পরই ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে জোট এবং প্রার্থী নির্বাচনে আলোচনা তুঙ্গে। এবার দলীয় প্যানেলের বদলে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ নিয়ে সমন্বিত প্যানেলের দিকে ঝুঁকছে অধিকাংশ সংগঠন। বিভিন্ন সংগঠনের বাইরে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির তরুণ নেতাদের প্যানেলে রাখার ভাবনা রয়েছে।
নির্বাচনের ফল নির্ধারণে নারী, সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট বড় ফ্যাক্টর হতে পারে বলে মনে করছেন ছাত্ররাজনীতির বিশ্লেষকরা।
সম্ভাব্য প্রার্থী কারা
২৮টি পদের বিপরীতে কে হবেন প্রার্থী, তা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। আলোচনায় আছেন:
ছাত্রদল: আবিদুল ইসলাম খান, বি এম কাওসার, তানভীর বারী হামিম।
ইসলামী ছাত্রশিবির: আবু সাদিক কায়েম, এস এম ফরহাদ ও মহিউদ্দিন খান।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ: আবু বাকের মজুমদার, জাহিদ আহসান, তাহমিদ আল মুদ্দাসির, আবদুল কাদের।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন: উমামা ফাতেমা।
ঢাবি সাংবাদিক সমিতি: মহিউদ্দিন মুজাহিদ।
ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রমৈত্রী: মেঘমল্লার বসু, জাবির আহমেদ।
ছাত্র অধিকার পরিষদ: বিন ইয়ামিন মোল্লা।
এছাড়া চারটি নতুন পদ যুক্ত হয়েছে: গবেষণা ও প্রকাশনা, ক্যারিয়ার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ, মানবাধিকার ও আইনবিষয়ক সম্পাদক।
পক্ষ-বিপক্ষের বক্তব্য
নির্বাচন তফসিল ঘোষণায় ‘আকরস্মিকতা’ ও ‘আলোচনার অভাব’ রয়েছে বলে মনে করছেন ছাত্রদলের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন। তার মতে, সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির বিষয়ে প্রশাসন প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পালন করেনি।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সাধারণ সম্পাদক শিমুল কুম্ভকার বলেন, “ডাকসু গঠনতন্ত্র ও কাঠামোর সংস্কার ছাড়া এই নির্বাচন কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনবে না। তারপরও নিয়মিত নির্বাচনের সংস্কৃতি গড়ার পক্ষে আমরা।”
অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আবদুল কাদের মনে করেন, “শিক্ষার্থীদের আশা যেন হতাশায় রূপ না নেয়, প্রশাসনের সেদিকে নজর রাখা জরুরি।”
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম ডাকসু নির্বাচনের তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “জুলাইয়ের আন্দোলনের অন্যতম চাওয়া ছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচন। এখন সেটা বাস্তবায়নের দিকেই এগোচ্ছে।”
ছাত্র মৈত্রীর জাবির আহমেদ মনে করেন, “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা জরুরি। অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব ঠেকানো না গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না।”
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে টিএসসি চত্বর এখন ফের আলোচনায় সরগরম। একদিকে আছে ছাত্রদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলনের অর্জন, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাংগঠনিক চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই স্পষ্ট হবে, এবারের ডাকসু কি আদতেই হবে একটি শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক নির্বাচন, নাকি আবারও দলীয় রাজনীতির পুনরাবৃত্তি?
Leave a Reply