গাজা উপত্যকায় পশ্চিমা সমর্থিত ইসরাইলি গণহত্যা তার সবচেয়ে মারাত্মক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে এবং বিশ্ব এখনো ঘুমিয়ে রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১০০ প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে, যাদের অধিকাংশই মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের মধ্যে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় মিসর ও ইসরাইল দ্বারা অবরুদ্ধ ছোট উপকূলীয় অঞ্চলটি এখন শিশুদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান, যারা জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর ইউনিসেফ গাজাকে ‘শিশুদের জন্য একটি কবরস্থান, অন্য সবার জন্য একটি জীবন্ত নরক’ হিসাবে বর্ণনা করেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ লাজারিনি ইতঃপূর্বে গাজায় ইসরাইলি ‘হত্যার ম্যাকিয়াভেলিয়ান পরিকল্পনা’ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন।
খোলাবাজারে, পানি সংগ্রহের জায়গাগুলোতে, ত্রাণ বিতরণের জায়গাগুলোতে লাইনে অপেক্ষমাণ শিশুদের ভঙ্গুর দেহের মধ্য দিয়ে চলে যায় ক্ষেপণাস্ত্র ও গুলির ছররা। স্থানচ্যুত শিশুদের তাঁবুর ভেতরে বোমা ফেলা হয়, স্কুল আশ্রয়কেন্দ্রে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং তাদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা দেওয়া হয়। এমনকি জন্মের আগেই মায়ের গর্ভের ভ্রুণগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
এটি ইসরাইলিদের ভবিষ্যৎ ভীতি দূর করার একটি কৌশল। অবরোধের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী ফিলিস্তিনিদের একটি প্রজন্ম, যাদের রয়েছে বেঁচে থাকার সহজাত আকাঙ্ক্ষা, তাদের ধ্বংসের ওপর নির্মিত একটি বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভিত্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
গত ১২ জুলাই ১৭ বছর বয়সি ইউসেফ আল-জাক তার ভাতিজি মারিয়া এবং ভাতিজা তামিমের সঙ্গে গাজা শহরে তাদের ভবনে ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়। একসময় সর্বকনিষ্ঠ ফিলিস্তিনি জিম্মি হিসাবে পরিচিত ইউসুফ ২০০৮ সালে ইসরাইলি কারাগারে জন্মগ্রহণ করে। তার মা ফাতেমা আল-জাক ২০০৭ সালে অধিকৃত পশ্চিম তীরে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় গ্রেফতার হন এবং বন্দিদশার প্রাথমিক পর্যায়ে জানতে পারেন যে তিনি দুই মাসের গর্ভবতী। ইউসুফের কাজিন আহমেদ শাহমুদ আমাকে বলেন, ‘ইসরাইলি দখলদাররা তার মাকে নির্যাতন করেছিল যাতে তার গর্ভপাত হয়।’
ফাতেমা একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রসবের সময় তার হাত ও পা শিকল দিয়ে বাঁধা ছিল এবং তিনি ইসরাইলি কারাগারের রক্ষীদের কাছ থেকে ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা পেয়েছিলেন।
ইউসুফ তার জীবনের প্রথম ২০ মাস কারাগারে কাটিয়েছে। ২০০৯ সালে ইসরাইলি জিম্মি গিলাড শালিতকে জীবিত দেখানো একটি ভিডিওর বিনিময়ে তাকে এবং তার মাকে অন্য ১৯ জন ফিলিস্তিনি নারী বন্দির সঙ্গে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
গত বছর গাজা থেকে পালিয়ে এসে এখন মিসরে বসবাস করা সাংবাদিক শাহমুদ বলেন, ‘ইউসুফের বাড়িতে আসার পর তার প্রতি অনেক মনোযোগ ছিল। আল-জাক পরিবার তাকে ‘পরিবারের ফুল’ বলে অভিহিত করেছিল। সে একটি শান্ত ছেলে ছিল এবং তার পাড়ার মানুষজন তাকে খুব ভালোবাসত।
আট ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ইউসুফ একটি পূর্ণ জীবনযাপন করতে বদ্ধপরিকর ছিল এবং ভ্রমণ করতে চেয়েছিল। তবে শাহমুদ বলেন, পরিবারটি বিশ্বাস করে, ইউসুফকে ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে লক্ষ্যবস্তু করেছিল। সাবেক ফিলিস্তিনি বন্দিদের লক্ষ করে হত্যা করার ইসরাইলের ইতিহাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউসুফের জন্মকাহিনী দখলদারিত্বকে উন্মোচিত করেছিল। এ কারণেই তারা চায়নি সে বেঁচে থাকুক। ইসরাইলিরা তাদের কারাগারে জন্মগ্রহণকারী ইউসুফকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে অসন্তুষ্ট হয়েছিল। সে তাদের বিরুদ্ধে একটি বিজয়ের প্রতিনিধিত্ব করছিল।
গাজায় গত ২১ মাস ধরে মৃত্যু একটি মারাত্মক ধ্রুবক হয়ে উঠেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ১৭ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। এ সংখ্যার অর্থ হলো, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল প্রতিদিন গড়ে ৩০টি শিশুকে হত্যা করেছে, যা প্রতি ৪৫ মিনিটে একটি শিশু হত্যার সমতুল্য।
এই গণহত্যার প্রথম দিন থেকেই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় শিশুসহ গণহত্যার ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য আমালেকের বাইবেলের গল্পটি অবতারণা করেছিলেন। ইহুদিবাদী রাব্বিদের রায় এবং ইসরাইল সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যের মাধ্যমে শিশুদের হত্যা ও বিকলাঙ্গ করার বিষয়টিকে সম্পূর্ণ বৈধতা, এমনকি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে-যা আন্তর্জাতিক আইনে একটি যুদ্ধাপরাধ। এ ধরনের অমানবিক ভাষা এবং অন্যের প্রতি ভয়সহ এই পরিসংখ্যানগুলো খোলাখুলিভাবে ফিলিস্তিনি শিশুদের এবং ‘সন্ত্রাসী উৎপাদনকারী নারীদের’ নির্মূল করার আহ্বান জানায়। ইসরাইল ঘোষণা করে, ‘গাজায় কোনো নির্দোষ নেই’, প্রতিটি ফিলিস্তিনি শিশু ‘তার জন্মের মুহূর্ত থেকেই সন্ত্রাসবাদী’।
ইসরাইল তার এ লক্ষ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। ১৯৪৮ সালে বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূলকরণ কখনো বন্ধ হয়নি। গণহত্যা আর কেবল একটি উদ্দেশ্য নয়, এটি ইসরাইলের সরকারি কৌশল। গাজার জনসংখ্যা কমিয়ে আনা এখন সরকারি আনুষ্ঠানিক নীতি। গাজার শিশুরা কেন? গাজার দশ লাখ শিশু একটি ক্রমবর্ধমান যুব জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে। এটি ইসরাইলি সমাজের জন্য একটি জনতাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ।
শিশুদের লক্ষ্যবস্তু করার আরেকটি ঘৃণ্য উদ্দেশ্য রয়েছে : একটি আদি সমাজের সামাজিক প্রজননের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ। এর লক্ষ্য হলো, সাম্প্রদায়িক বন্ধন ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে ফেলা। গাজার শিশুরা ঠিক সেই ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করে, যার মূলে রয়েছে জ্ঞান এবং ঐতিহাসিক স্মৃতি। এ অঞ্চলের সর্বোচ্চ সাক্ষরতার হারসহ একটি সমাজ, যেখানে কয়েক দশক ধরে অবরোধ ও বোমাবর্ষণ সত্ত্বেও শিক্ষিত যুবকরা কেবল বেঁচে থাকার প্রতীক নয়, তারা মুক্তির প্রতিনিধি। তাই, শিশুদের লক্ষ্যবস্তু করা একটা কৌশল। এটি আশাকে ধ্বংস করার, ভবিষ্যতের ওপর পুনর্লিখন করার এবং ভয় ও নির্মূলের মাধ্যমে দখলদারত্ব জারি রাখার একটি বৃহত্তর অভিযানের অংশ।
মিডলইস্ট আই থেকে ভাষান্তরিত
লিনাহ আলসাফিন : ফিলিস্তিনি সাংবাদিক
Leave a Reply